সমস্ত লেখাগুলি

তোমার সুরে সুরে -
এণাক্ষী সাহা
Nov. 27, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:811 | likes:3 | share: 0 | comments:0

গণিত কী? গণিত আমাদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? কেউ বলবে,

"বা রে! এটা আবার প্রশ্ন হল? সকালে কখন উঠব, কোন কাজে কত সময় দেব, কতক্ষন পড়াশোনা করব, বাজার করতে গিয়ে কিভাবে দরদাম করব, দিনের শেষে আয়ব্যয়ের হিসেব করবো -- গণিত ছাড়া তো কোনোটাই হবে না।"

চিন্তাশীল ছাত্ররা আরেকটু গভীরে গিয়ে বিষয়টা ভাববে। তারা বলবে, "হুম... গণিত তো একটা গুরুত্বপূর্ণ tool -- পদার্থবিদ্যা হোক বা জীববিদ্যা, কিংবা রসায়ন। সবেতেই তো গণিতের কমবেশি প্রয়োগ রয়েছে। গণিত না শিখে কোনোটাকেই শেখা যাবে না।"


উপরের কথাগুলো প্রতিটিই ঠিক। এ কথা মোটেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে জীবনের সবক্ষেত্রে গণিত কতটা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে!

এবারে আরেকটু গভীরভাবে ভাবা যাক, মনটাকে আরো একটু শান্ত করে। কেন গণিত বিষয়টা সবকিছুতে নাক গলালো এরকম? কেন উচ্চস্তরে গিয়ে গণিত এবং পদার্থবিদ্যা পরস্পরের আরো কাছাকাছি চলে আসে? কেন মহাবিশ্বের সবকিছুকেই এদের মাধ্যমে ব্যাখ্যা দেওয়া যায় বা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়?

আসলে পুরো বিষয়টা যেন একটা সেট অফ রুলস -- যা পুরো বিশ্বজগতে একই। আর তা সৃষ্টির আদিকাল থেকেই এক। কোথাও কোনো অন্যথা নেই। আমরা গণিত তৈরি করিনি, আমাদের জন্মের আগে থেকেই গণিত রয়েছে। তখনই মনে প্রশ্ন জাগে যে কেন এমনটা হলো - কে তৈরি করলো এই নিয়মগুলো। ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে আমরা ধরে নিই ঈশ্বরই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তাহলে বিজ্ঞানকে ঈশ্বরের ভাষা আর গণিতকে সেই ভাষার ব্যাকরণ বললে অত্যুক্তি হয় কি?


এতক্ষণে নিশ্চয়ই একটু হলেও উপলব্ধি করা যাচ্ছে যে জীবনে গণিতের গুরুত্বটা আসলে আলু-পটলের দরদাম বা সিমেন্ট-বালির হিসেব কিংবা পদার্থবিদ্যার পরীক্ষায় পাশ করার চেয়ে অনেক অনেক বেশি গভীর! মহাবিশ্বের সুনিপুণ সূক্ষ্ম ডিজাইনকে জানার উপায় হলো গণিত। মহান স্রষ্টার লীলাখেলা বোঝার উপায় হলো গণিত। 


একটু নিজের দিকে তাকানো যাক। এই যে আমি, একজন গণিতপ্রিয় ছাত্রী (যদিও পড়ছি ডাক্তারি), আমার আসল পরিচয় কী? আমার signature কী? আমিও মানুষ। আরেকটা মানুষের সাথে আমার পার্থক্য কোথায়? কেউ বলবে, জেনেটিক গঠন। তোমার আমার জিনের মৌলিক উপাদানে কি আদৌ কোনো পার্থক্য আছে? নেই। তোমার ডিএনএ-তে যেসব পিউরিন বা পিরিমিডিন বেস রয়েছে আর আমারটায় যেসব রয়েছে, তারা একই। দেহকে অণু-পরমাণু স্তরে গিয়ে বিশ্লেষণ করলে বিষয়টা সবচেয়ে সহজে অনুভব করা যায়। যদি বলি, আমাদের পার্থক্য রয়েছে আমাদের চিন্তা, চেতনা, অনুভূতির মধ্যে, তাহলে তো এটাও জানা যে সেগুলোর উৎসস্থল আমাদের ব্রেন। কিন্তু ব্রেনের মধ্যেও তো তফাৎ নেই! মৌলিক উপাদানটা তো একই - একগুচ্ছ নিউরন, যাদের আন্তঃযোগাযোগের ফলে জন্ম নেয় সব চিন্তা, চেতনা, অনুভূতি; তৈরি হয় বুদ্ধি, স্মৃতি, যুক্তি। তোমার নিউরন আর আমার নিউরন তো একই, একই অণু পরমাণু কিংবা আরো গভীরে গিয়ে বলতে হলে, একই মৌলিক কণা দিয়ে তৈরি। সবই ইলেকট্রন প্রোটন নিউট্রনের খেলা। এদেরই একেকরকম সজ্জা, একেকরকম ইন্টারঅ্যাকশন দিয়ে তৈরি হয় একেকটা মৌল। সেইসব মৌল জুড়ে তৈরি হয় অসংখ্য রকমের যৌগ। একেকরকম তাপমাত্রায় তাদের একেক রকম আচরণ। ভেতরে সবটাই আসলে এক। দূর আকাশের নীহারিকার ভেতরে যা আছে, ঠিক সেই উপাদানই রয়েছে একটা পিঁপড়ের শরীরেও। 

যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে,

তাই আছে দেহভাণ্ডে।


অর্থাৎ এই সম্পূর্ণ বিশ্বজগৎ জুড়ে ছড়িয়ে আছে একই উপাদান, এক মহাচৈতন্য, এক আদি অপরিবর্তনীয় সত্ত্বা-- যাকে আমাদের বৈদিক যুগের মুনি-ঋষিরা বর্ণনা করেছেন ব্রহ্ম নামে। উপনিষদে ব্রহ্ম কথার ধ্বনিগত অর্থ হিসেবে বলা আছে - যা সর্বব্যাপী, যা সকল বস্তুর মধ্যে  প্রচ্ছন্নভাবে ব্যাপ্ত। এই আদিসত্ত্বাই বিশ্বজগতের উৎস, বিশ্বজগৎ আসলে এই বিমূর্ত আদিসত্ত্বারই মূর্ত প্রকাশ। মূর্ত বলেই সেখানে নানারকম ভাঙা গড়ার খেলা চলে প্রতিনিয়ত। কোয়ান্টাম থিওরিও এই পরিবর্তনশীল জগতের মূর্ত রূপের মধ্যে মিশে থাকা বিমূর্ত সত্ত্বার অস্তিত্বকে সমর্থন করে। আসলে সবই ব্রহ্ম। জগতের সবকিছুর মধ্যেই পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে ব্রহ্ম। ব্রহ্মই আমাদের উৎস, বিনাশের পরেও ঠিকানা সেই ব্রহ্ম। আমাদের সম্পূর্ণ জীবনটাই এক অসাধারণ যাত্রা -- ব্রহ্ম থেকে সৃষ্টি হয়ে ব্রহ্মের সাথেই মিলিত হওয়ার যাত্রা! কারোর ক্ষেত্রে এই যাত্রার পথ হয় জ্ঞানযোগ, কারোর ক্ষেত্রে কর্মযোগ, কারোর ক্ষেত্রে ভক্তিযোগ আবার কারোর ক্ষেত্রে হঠযোগ। ব্রহ্ম যেন চরাচরব্যাপী এক অপূর্ব সুর! যে সুর শোনার জন্য মনের সঠিক টিউনিং দরকার --

কবিগুরুর ভাষায়,

"আমার এ তার বাঁধা কাছের সুরে

ঐ বাঁশি যে বাজে দূরে,

গানের লীলার সে কিনারে 

যোগ দিতে কি সবাই পারে,"


সেজন্যই তো বিজ্ঞানের চর্চা, গণিতের চর্চা! তুমিও ব্রহ্ম, আমিও ব্রহ্ম। "তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে"-ই তো জীবনের বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যায়। তাই গণিত শুধুই দুয়ে দুয়ে চার আর মাইনাসে মাইনাসে প্লাস এর মত কয়েকটা সূত্র নয়। গণিত মানে একগুচ্ছ চাবি -- মহাসৃজনের অজানা রহস্য উদ্ঘাটনের চাবি।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86930